জ্যঁন পল সার্তরাকে ফ্রানৎস ফার্নো কি বললেন?
জ্যঁন পল সার্তরা (Jean Paul Sartre) একবার—১৯৪৮ ইংরেজিতে কালাে অরফিয়ুস (Orphée noir) বইয়ের ভূমিকায় লিখিয়াছিলেন: যে সকল কালাে মুখে ঠুলি পরাইয়া তােমরা এতদিন চুপ করাইয়া রাখিয়াছিলে সেই সব ঠুলি এখন খুলিয়া দিয়া তুমি কী আশা করিতেছ?
তাহারা তােমার হামদ ও নাত পাহিবে? এইসব মাথা আমাদের পূর্বপুরুষেরা একদা জোর করিয়া দাবাইয়া দিয়াছিলেন, এখন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার পর তাহাদের চোখ হইতে তুমি কী প্রেম আর প্রীতি আশা করিতে পারাে? (দেখুন, ফার্নো ১৯৭০: ২২)
উত্তরে ফার্নো বলিয়াছিলেন না। তবে শুদ্ধ এইটুকু বলিব আমার চোখে কোন গােনাগুণতিও নাই, কোন ঘৃণাও নাই। আছে শুদ্ধ প্রশ্ন, চিরস্থায়ী প্রশ্ন। যে আমার চোখে অন্য কিছু দেখিবার আশায় তাকাইবে সে দৃষ্টিশক্তি হারাইবে।' আত্মহত্যায় যে প্রস্তুত নহে, যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা রক্ষা করিতে যে সদা জাগ্রত নহে, সে মানুষ হয় নাই। হেগেলের এই প্রস্তাব শুদ্ধ যাহার বেলায় প্রযােজ্য সে একই সঙ্গে যেমন মানুষ তেমনি প্রভুও বটে। তাঁহার প্রস্তাবের নির্গলিতাৰ্থ, যে প্রভু হয় নাই সে মানুষই হয় নাই। জঁ-জাক রুসাের কথাটা তাই আমাদের পাল্টাইয়াই বলিতে হইবে। মানুষ স্বাধীন হইয়া জন্মায় নাই—তাহাকে স্বাধীন হইয়া উঠিতে হইবে।
হেগেল ভাবিয়াছিলেন কিছু মানুষরূপ আছে যাহারা কোন দিন মানুষ হইবে না—তাহারা প্রাণীই থাকিয়া যাইবে। তাহার অভিধানে মানুষরূপী প্রাণীর অপর নাম তাই দাস। এই মনীষীর এক বাক্য অনুসারে মানুষ মাত্রই যেমন প্রভু হইতে পারে তেমনি দাসও বনিতে পারে। তাহার অন্য বাক্য অনুসারে আবার যে প্রভু হয় নাই সে মানুষই হয় নাই। ইহা আমরা একটু আগেই দেখিয়াছি। তাহার কথার স্ববিরােধ এইখানে যে, এক অর্থে দাস হইয়াও কোন কোন মানুষ পদবাচ্য, আবার অন্য অর্থে মানুষের সংজ্ঞাই এমন যে সে দাস হইতেই পারে না।
যাঁহারা বলিয়া থাকেন কালাে মানুষ, আরব মানুষ, পরাজিত মানুষ ইতি আদি মানুষ আর কোন দিন মানুষ হইবে না, শুদ্ধ দাসই থাকিয়া যাইবে তাহাদিগকেই বলা হয় রক্তবাদী বা বর্ণবাদী। কারণ তাঁহারা গাত্রবর্ণের বা রক্তধারার সহিত মনুষ্যত্বের সম্পর্ক আবিষ্কার করিয়াছেন। বর্ণবাদীরা পরের দেশ দখল করিয়া রাখিবার সপক্ষে যুক্তিস্বরূপ যােগ করিলেন, কালাে মানুষ চিরকালই দাস থাকিবে।
এই কথায় অন্যরাও স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীরাও—সায় দিলেন। ইহারা নাকি এয়ুরােপের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ফ্রানৎস ফানোর বিচারে বর্ণবাদ এই কারণেই আমেরিকা ও এয়ুরােপের সাধারণ দৌলত, সার্বজনীন সম্পত্তি। তাঁহার গুরু কবি এমে সেজারের দোহাই পাড়িয়া তিনি দেখাইয়াছেন নাৎসি নেতা আডলফ হিটলারের বর্ণবাদ হইতে আর দশ বুর্জোয়া এয়ুরােপীয় ভদ্রলােকের বর্ণবাদ মােটেও আলাদা নহে।
কিছু কথা সেজারের বক্তৃতা হইতে তিনি উদ্ধার করিয়াছেন: রেডিও খুলিতেই যখন শুনি মার্কিন মুলুকে কালােদের ধরিয়া ধরিয়া ঝুলাইয়া মারা হইতেছে, তখনি বলি আমাদের এতদিন মিছাকথা শােনানাে হইয়াছে: হিটলার মারা যায় নাই। রেডিও খুলিতেই যখন শুনি এয়াহুদিদের অপমান করা হইয়াছে, অপদস্থ করা হইয়াছে, উৎপীড়িত করা হইয়াছে, তখনি বলি আমাদের মিছাকথা শােনানাে হইয়াছেঃ হিটলার মারা যায় নাই।
শেষমেশ রেডিও খুলিতেই যখন শুনি আফ্রিকায় জবরদস্তি করিয়া বেগার শ্রম আদায়ের প্রথা চালু করা হইয়াছে, আইনের আওতায়ও আনা হইয়াছে, তখনি বলি আমাদের সত্য সত্য মিছাকথা শােনানাে হইয়াছে। হিটলার মারা যায় নাই।'
তাহা হইলে কী দাঁড়াইল? কোন কোন মনীষী বলিলেন, পরদেশ দখল করিয়া বর্ণবাদী শাসন চালু করার অপরাধে এয়ুরােপীয় সভ্যতা এবং ইহার যাহারা শ্রেষ্ঠ সন্তান তাঁহারা দায়ী নহেন। এই বর্ণবাদের দায় তাহা হইলে শুদ্ধ চোর-ডাকাত আর রাষ্ট্রনেতাদেরই? সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ ইহার দায় নিবেন না?
অন্য এক ফরাসি মনীষীর বরাত দিয়া ফানা লিখিলেন—নিতে হইবে। যে জাতির নাম ভাঙ্গাইয়া অপরাধ করা হয় সে জাতির প্রত্যেক সদস্যই তাহার জন্য দায়ী। এয়ুরােপ ও আমেরিকার এই অপরাধ, এই দায় আছে বলিয়াই কি তাহারা আর দশ নিষ্ঠুরতাকে যত ভয় পাইতেছেন, ঘৃণা করিতেছেন আদমবােমায় তাহার চেয়ে ঢের বেশি ঘৃণা অনুভব করিতেছেন আর ভয় পাইতেছেন? হয়তাে তাহাই।
চলবে....